ছবি: দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট, akkerwijzer.nl ও nightmare ছবির পোস্টার থেকে নেওয়া এবং এডিট করা (কোলাজ)
বাঙালি জাতির হরেক রকম পরিচয়
আছে। এ রকমই একটি পরিচয়- বাঙালিরা হলো আড্ডাবাজ জাতি। বাসা-বাড়িতে, অফিসে, হোটেল- রেস্তোরায়,
বাস-গাড়িতে কিংবা চায়ের টং দোকানে আড্ডা চলে সমান তালে। এ রকমই এক চায়ের টং দোকান ঘরে
আমি আর আমার বন্ধু সন্ধ্যার পর প্রায় নিয়মিতই আড্ডা দেই। আমাদের আড্ডা কোন নির্দিষ্ট
বিষয় নিয়ে না হলেও ঘুরে ফিরে কেন জানি রাজনীতি আর দেশ বিষয়ে এসে ঘুরপাক খায়।
পিঁয়াজ নিয়ে গোটা দেশ সরব
ছিল ২০১৯ এর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়টাতে। হঠাৎ করে এর দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্নবিত্ত
ও মধ্যবিত্ত পরিবার খুব সমস্যায় পড়ে। নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্ত পরিবারই আমাদের দেশে
সংখ্যায় বেশি। আর এ কারণেই পরিবারগুলোর সাথে
থাকা সমাজ এবং সমাজ নিয়ে গঠিত দেশ নড়ে ওঠে। এরপরে দু-একদিনের জন্য লবণেও চলে এ কেরামতি।
তবে লবণ বিষয়টা পিঁয়াজের চেয়ে ভিন্ন। একটা সিন্ডিকেট আর একটা গুজব। গুজব নিয়ে আমার
আলোচনার বিষয় নয়। আজ সিন্ডিকেট নিয়ে বলতে চাই।
ছবি কৃতজ্ঞতা: গেটি ইমেজ (Hélène Desplechin)
পিঁয়াজের বিষয়টা সিন্ডিকেট
বলার বেশ কয়েকটা কারণ রয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোতে ‘পেঁয়াজের
পরিসংখ্যানেই বিভ্রান্তি’ শিরোনামে ২১ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে আসজাদুল কিবরিয়া একটা মতামত লিখেন। তিনি সেখানে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত
দিয়ে দেখান, আমাদের পিঁয়াজ ভোগের বার্ষিক চাহিদার তুলনায় পিঁয়াজের উৎপাদন এবং আমদানি কম ছিল না (তিনি বিভিন্ন তথ্যের অসামঞ্জস্যতার
বিষয়টাও তুলে ধরেন)। সুতরাং ভারতের হঠাৎ পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ হওয়াতে সমস্যা হওয়ার কথা
না।
যাইহোক, ফিরে যাই আমাদের
আড্ডায়। গত কয়েকদিনে আমাদের আড্ডার বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের কৃষি খাত নিয়ে। আমাদের
দুজনের কথার সারবস্তু ছিল বাংলাদেশের কৃষি খাত কেন অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে এবং কৃষকরা
কৃষি কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় শিফট করবে। আমাদের আড্ডা যে অন্তঃসারশূন্য ছিল না তা এই মতামত
লেখার সময় আরো দৃঢ় হয়।
২৮ ডিসেম্বর ২১০৫, জনকণ্ঠ
পত্রিকায় ‘কৃষির সাথে জড়িত মানুষের সংখ্যা কমছে’ এ শিরোনামে একটা রিপোর্ট করে। রিপোর্টটি
করা হয় হোটেল সোনারগাঁওয়ে ‘খাদ্য নিরাপত্তা এবং পণ্য ন্যস্তকরণে
গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শির্ষক এক সেমিনারের উপর ভিত্তি করে। প্রাক্তন প্রধান তথ্য
কমিশনার প্রফেসর ড. মোঃ গোলাম রহমান এ অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন।
সেমিনারের মূল প্রবন্ধকার কৃষিক্ষেত্রে চারটি সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। এর মধ্যে মূল
দুটি সমস্যা হলো- কৃষিতে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য এবং কৃষকদের
পেশা পরিবর্তনের মরিয়া ভাব। ২০১৯ সালের শেষের দিকে এই মূল দুই সমস্যা বেড়েছিল না কমেছিল
তা সহজেই অনুমান করা যায়।
ছবি: ঢাকা ট্রিবিউন থেকে নেওয়া
ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা
করেই বলি। আমাদের দেশ কৃষি প্রধান। এ দেশের মাটি এতটাই উর্বর যে, এখানে গাছ, শাক-সবজি
জন্মাতে কোন কসরত করা লাগে না। সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলেই কংক্রিটের মাঝেও শস্য ফলানো
যায়। অন্যদিকে, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী বেশ কিছু দেশ শস্য ফলানোর জন্য অনেক ব্যয়বহুল
পদ্ধতি অবলম্বন করে। তাদের মাটি ফসল ফলানোর মতো উর্বর নয় বলে তাদের এ কাজ করতেই হয়।
অনেক কষ্টের পর কৃষিতে তাদের সফলতা আসে। সহজে পেয়ে যাই বলে সম্ভবত আমরা এই কৃষি কাজের
কদর করি না। পল্লীগীতির গানে-
“যে জন প্রেমের ভাব জানে না
তার
সঙ্গে নাই লেনা-দেনা
খাঁটি
সোনা ছাড়িয়া যে নেয় নকল সোনা
সে
জন সোনা চেনে না।।
…………………………………………………
মাটির প্রেমের মূল্য কে জানে
ধরায় আছে কয় জনা।।”
ধরায় আছে কয় জনা।।”
ছবি: investindia.gov.in থেকে নেওয়া
বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মী,
গবেষক এবং বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, এ দেশের উন্নয়নে কৃষি মডেল বাদ দিলে দেশের উন্নয়ন অনেকাংশেই
বাধাগ্রস্ত হবে। আর দেশকে কৃষিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে কৃষকরা যাতে কৃষি উৎপাদন বন্ধ
না করে তার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার কৃষি উৎপাদনের দরকারি পণ্য সারে ভর্তুকি
দেয়। জাপান কৃষকদের কাছ থেকে উচ্চ মূল্যে ধান কেনে। এ ধরনের উদ্যোগ কৃষকদের উৎসাহ দেয়।
তবে কৃষিখাত এবং কৃষকদের রক্ষা করতে এগুলো যথেষ্ট নয়। কৃষিখাত এবং কৃষকদের সকল প্রতিবন্ধকতা
দূর করতে হবে। কীভাবে তাদের সে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করা যায় সে বিষয়টা এখন বলছি।
একজন কৃষক (দিন চুক্তিতে
যারা কাজ করেন তারা নন) মূলত একজন বিনিয়োগকারী। একজন বিনিয়োগকারী যখন অর্থ লগ্নি করেন
তখন তার উদ্দেশ্যই থাকে মুনাফা। তিনি মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম না হলে ভবিষ্যতে সে ক্ষেত্রে
বিনিয়োগে যেতে চান না। কৃষকের ক্ষেত্রেও একই কথা। আমাদের অধিকাংশ কৃষকদের মুনাফা তো
দূরের কথা, খাটানো টাকাই উঠে আসে না। ফসলের সঠিক দাম না পাওয়ার ফলে কৃষকদের রাস্তায়
পিঁয়াজ ঢেলে দেওয়া, ধান পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও আমরা দেখেছি।
এসব কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবলে
ভুল হবে। যোগসূত্র আছে একটার সাথে আরেকটার। ধরা যাক, একজন কৃষক এক বিঘা জমিতে শীতকালীন
সবজি লাগিয়েছেন। তার মোট খরচ হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। সময় ব্যয় করেছেন দুই মাস। এই জমিতে
তার ফলন হয়েছে দশ মণ সবজি। এবার বিক্রির পালা। বিক্রির সময় তার তার সংসারের খরচ, বিনিয়োগের
অর্থ এবং সময় ব্যয় এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হয়। এবার ভাবুন, এই দশ মণ সবজি তার কত টাকায়
বিক্রি করা উচিত? তিনি যদি দাম না পান তবে তিনি কী করবেন? তিনি যদি প্রতিবাদের ভাষা
হিসেবে ফসল নষ্ট করেন তবে সেটা কি অস্বাভাবিক হবে?
এবার আসা যাক সাপ্লাই চেইনের
জায়গায়। ধরা যাক, কৃষক আলু উৎপাদন করার পর প্রতি কেজি বিক্রি করলেন ৮ টাকায়। এবার ফসল
সংগ্রহকারী ফসল মজুতদারদের কাছে ১০ টাকায় বিক্রি করলেন। ফসল মজুতদার অর্ধেক আলু পাইকারি
বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করলেন ১২ টাকায়। আর অর্ধেক রেখে দিলেন হিমায়িত গুদামে। তিন
মাস গুদামজাত করা বাবদ তার খরচ হলো প্রতি কেজিতে ৬ টাকা। তাহলে তার ক্রয়মূল্য আর গুদামজাত
খরচ মিলিয়ে মোট ব্যয় হলো ১৬ টাকা।
এবার হঠাৎ বিদেশ থেকে আলু
আসা বন্ধ হয়ে গেলো কোন কারণে। এখন সেই মজুতদার ইচ্ছা মতো দামে আলু বাজারে ছাড়তে পারেন।
সবাই নিতে বাধ্য, কারণ তখন বাজারে আলু নেই। ব্যাপারটা এতটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলেও কৃষক
এবং ভোক্তাদের এতো ক্ষতি হতো না। এর সাথে যোগ হলো সিন্ডিকেট। এবার পুরো দেশে দাম বাড়তে
বাড়তে ৫০ টাকা দরে আলু বিক্রি হওয়া শুরু করলো। শহরেও যে দাম গ্রামেও সে দাম। কষ্টকর
বিষয় হলো, যে কৃষক আলুর চাষ করেছিল তার কাছে আর আলু না থাকায় তাকেও ৫০ টাকায় আলু কিনতে
হলো। তিনি কিন্তু বিক্রি করেছিলেন মাত্র ৮ টাকায়। এবার যদি তিনি আত্মহত্যা করেন তাহলে
দায়টা কার?
অথচ, একটু সুন্দর ব্যবস্থাপনার
মাধ্যমে কৃষক, আড়ৎদার, মজুতদার, বিক্রেতা এবং ক্রেতা সবার স্বার্থ রক্ষা করা যেতো।
আড্ডার মাঝে আমরা অনেক যুক্তি তর্ক করলেও একটা বিষয়ে একমত হয়েছিলাম। আর সে বিষয়টা হলো
সরকারি ব্যবস্থাপনা। সরকারের সদিচ্ছাই পারে আমাদের কৃষি খাতকে এবং কৃষকদেরকে ডুবে যাওয়ার
হাত থেকে রক্ষা করতে।
ছবি: developmentchannel.org থেকে নেওয়া
প্রথমত, সরকার ব্যবস্থাপনার
মাধ্যমে কৃষকদের সুবিধা-অসুবিধাগুলো খুঁজে বের করবে। তারপর তাদের ফসলের নায্য মূল্য
নির্ধারণ করবে। সরকার নির্ধারিত মূল্যের কমে যেন কেউ কৃষকদের কাছ থেকে ফসল না কিনতে
পারে তার জন্য নজরদারির ব্যবস্থা করবে। শুধু তাই নয় পুরো সাপ্লাই চেইনটাই সরকার নজরদারিতে
রাখবে যাতে ক্রেতাদের কাছে সে ফসল নায্য মূল্য সরবরাহ করা যায়।
এ ছাড়াও সরকারি এবং বেসরকারি
মাধ্যমে আরো কিছু বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন, সাপ্লাই চেইনের এই কৃষক
থেকে ক্রেতার মাঝখানের দূরত্ব কমানোর উদ্যোগ নেওয়া। মধ্যস্বত্বভোগী
যত কমানো যাবে ততই কৃষক এবং ক্রেতার মাঝের দূরত্ব কমবে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষা
করা যাবে। এটা করা তেমন কঠিন কোন কাজ নয়।
একটা অ্যাপের মাধ্যমেই এ
সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। ধরা যাক, অ্যাপের নাম ‘সেতু বন্ধন’। এখন এই ‘সেতু বন্ধন’
অ্যাপে থাকবে সর্বোচ্চ তিন থেকে চারটি পক্ষ। এর মধ্যে দুই পক্ষ হলো কৃষক এবং সাধারণ
ক্রেতা। আরেক পক্ষ হলো অ্যাপ কতৃপক্ষ (সরকার হলে ভালো হয়)। আর চতুর্থ পক্ষ হিসেবে থাকতে
পারে-আড়ৎদার/মজুতদার/পাইকারি বিক্রেতা যে হোক না কেন।
ছবি: businesstimes.co.zw থেকে নেওয়া
এবার এই অ্যাপে কৃষক তার
পণ্যের মূল্য দিবেন। আর ক্রেতা (যেকোন পক্ষ) দরাদরি করে বা ঐ মূল্যে সম্মত হয়ে ক্রয়
করার জন্য অর্ডার করবেন। অ্যাপ কতৃপক্ষ একটি নির্দিষ্ট ফি এর মাধ্যমে ক্রেতার কাছে
পণ্য পৌঁছে দিবেন। অ্যাপে এলাকা ভাগ করা থাকবে। এতে যানবহন খরচ কমবে এবং পণ্য ক্রেতার
কাছে দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব হবে। শুধু তাই নয় এর মাধ্যমে কৃষকদের উৎপাদিত ফসল সঠিক সময়ে
বিক্রি মাধ্যমে নষ্টের হাত থেকে বাঁচানো যাবে।
অনেকে হয়তো বলবেন, এ কাজ
করার পরও তো মধ্যস্বত্বভোগী/সিন্ডিকেটের ব্যাপারটা সমাধান
হবে না। একদিনে যে সমাধান হবে না সেটাতো আমরা বলতেই পারি। তবে তাদের দৌরাত্ম্য যে কমে
যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সরকার কৃষকের নায্য মূল্য নিশ্চিত করবে। সাধারণ ক্রেতার
কাছে সাধ্যের মধ্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করবে। এরপরেও কি সিন্ডিকেটের ক্ষমতা থাকবে
তা ভেঙে ফেলার? সিন্ডিকেট ভাঙা কি এতই কঠিন?
Comments
Post a Comment