আমেরিকান
বিখ্যাত উপন্যাসিক গেইল গুডউইনের বলেছিলেন, উত্তম শিক্ষাদান পদ্ধতি
হলো- “এক চতুর্থাংশ প্রস্তুতি, তিন চতুর্থাংশ উপস্থাপনা”।
আমেরিকার বিখ্যাত দার্শনিক ও শিক্ষা সংস্কারক জন ডিউয়ির মতে, “আমরা যদি আজকের শিশুদের
গতকালের মতো করে পড়াই তাহলে আমরা তাদের আগামীকাল ছিনিয়ে নিলাম”।
কিন্তু
বাস্তবতা হলো বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই (বাংলাদেশ সহ) শিক্ষার ক্ষেত্রে এই দর্শনগুলো
অনুপস্থিত। এমনকি খোদ আমেরিকাতেও এর বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায় না। গেইল গুডউইন এবং জন
ডিউয়ি বোঝাতে চেয়েছেন শিক্ষার্থীদের শেখাতে গেলে শিক্ষকদের নিত্য নতুন পদ্ধতির চর্চা
করতে হবে। এবং তা শিক্ষার্থীদের উপস্থাপন করার আগে নিজে ভালো করে রিহার্সল করে নিতে
হবে। আর এগুলো না করলে আমাদের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ে যাবে, পড়ার আগ্রহ হারাবে।
দুঃখজনক
হলেও সত্য যে আমাদের দেশে পরিমাণকে গুণমানের চেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কতজন শিক্ষার্থী
পরীক্ষা দিয়ে পাস করলো কিংবা জিপিএ ফাইভ পেলো এটাকে সফলতা বলে ধরে নেওয়া হয়। অথচ গুরুত্বের
জায়গাটা হওয়া দরকার ছিল শিক্ষার্থীরা কতটা শিখতে পারছে তার উপর। এতে লাভটা হতো শেষে
বা আসল জায়গায় এসে।
প্রাথমিক
শিক্ষার ভিত ভালো হলে, মাধ্যমিকে উপকার হতো। মাধ্যমিকের ভিত ভালো হলে, উচ্চ মাধ্যমিকে
কাজে লাগতো। উচ্চ মাধ্যমিকের ভিত ভালো হলে, উচ্চ শিক্ষায় তার ফলাফল ভোগ করা যেতো। আর
উচ্চ শিক্ষার ফল নিতে পারলে তা কাজে আসতো প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে। সেটা হোক চাকরির জন্য
কিংবা জ্ঞান বিতরণে।
কিন্তু
আমাদের গোড়াতেই ভুল। আমরা শিক্ষার এই গুণমান কি করে ভালো করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করছি
না। আমরা চেষ্টা করছি বৃত্তি দিয়ে আর খাবার দিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনার। সেটাতে
আমরা সফলও হয়েছি। কিন্তু তাদের আমরা কতটা শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করতে পারছি তা দেখার
বিষয়।
যে প্রাথমিক
শিক্ষকগণ ভিত গড়ে দেবেন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, শিক্ষাদানের আগ্রহ, জ্ঞানের চর্চা
এবং নিত্য নতুন শিক্ষাদান পদ্ধতি শেখার আগ্রহ, তথ্য জানার আগ্রহ বিষয়গুলো গুণগত শিক্ষার
অন্যতম শর্ত। কিন্তু বাস্তবতা হলো প্রাইমারি শিক্ষকদের প্রায় ৪৩ ভাগ উচ্চ মাধ্যমিক
পাস। তার মধ্যে প্রায় ১৩ ভাগ আবার শুধুমাত্র মাধ্যমিক পাস। আর ট্রেইনিং নেই এমন শিক্ষকের
সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি। এ তথ্যগুলো মড়গড়া নয় স্বয়ং ব্যানবেইসের ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান
এটা বলছে।
এর জন্য
আমাদের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি এবং ব্যবস্থাপনা অনেকাংশেই দায়ি। প্রাথমিক শিক্ষক পদে আবেদন
করার যোগ্যতা মেয়েদের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক আর ছেলেদের জন্য ডিগ্রি পাস (বর্তমানে উভয়ের জন্যই স্নাতক/সমমান পাস)। যারা শিক্ষক
হিসেবে নিয়োগ পান তাদের ট্রেইনিং এর আগেই ক্লাস রুমে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ফলে শিশুদের
মনস্তত্ত্ব বুঝে কিভাবে শিখালে শিশুরা তা গ্রহণ করবে এটা বাদ পড়ে যায়। আর এটা বাদ পড়ে
যাওয়া মানে শিক্ষা দানের উদ্দেশ্য নিরানব্বই ভাগই ব্যর্থ। আর গোড়া কাঁচা বলে আমাদের
দেশে লাখে লাখে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর বের হচ্ছে কিন্তু দক্ষ কর্মী, শিক্ষক-গবেষক, বিভিন্ন
পেশা ভিত্তিক চাকুরিজীবী পাওয়া যাচ্ছে না। এটাই আমাদের দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা
এবং তার ফলাফল।
আমাদের
শিক্ষার মান বাড়াতে এবং এর ফল ভোগ করতে উন্নত শিক্ষা পদ্ধতির অনুসরণ করার কোন বিকল্প
নেই। বিশ্বে খুব কম দেশেই উন্নত শিক্ষা পদ্ধতি প্রয়োগ করছে। তবে আশার বিষয় হলো যে রাষ্ট্রগুলো
তাদের গবেষণালব্ধ সামগ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি প্রণয়ন করে অভূতপূর্ব সাফল্যে লাভ করেছে বিশ্ব
তাদের রোল মডেল হিসেবে ভাবছে এবং অনুসরণ করতে চাচ্ছে। এমনই দুটি রাষ্ট্র হলো ফিনল্যান্ড,
জাপান। সংক্ষেপে এই দুটি রাষ্ট্রের শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করছি।
ফিনল্যান্ডে
বাধ্যতামূলক শিক্ষাস্তর প্রথম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি। বাধ্যতামূলক শিক্ষা স্তর শুরু
হয় সাত বছর বয়স থেকে। যা বিশ্বের অন্যন্য দেশের চেয়ে এক থেকে দুই বছর বেশি। জাপানেও
বাধ্যতামূলক শিক্ষাস্তর প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত। তবে জাপানে বাধ্যতামূলক শিক্ষাস্তর
শুরু হয় ছয় বছর বয়স থেকে।
ফিনল্যান্ডে শিক্ষার্থীদের নবম শ্রেণি পর্যন্ত কোন বিশেষায়িত পরীক্ষা নেই। অর্থ্যাৎ
পাস ফেলের কোন ব্যাপার এই নবম শ্রেণি পর্যন্ত নেই। শ্রেণিকক্ষে মূল বিষয়ের ভিত্তির
উপর জোর দেওয়া হয়। খুবই কম বাড়ির কাজ। সারা দিনে মাত্র তিন থেকে চারটা ক্লাস থাকে ফিনল্যান্ডের
শিক্ষার্থীদের। ক্লাস পদ্ধতিতে প্রতিযোগিতার চেয়ে সহযোগিতাকে
প্রাধান্য দেওয়া হয়। এতে দলগত কাজ করার মন মানসিকতা গড়ে ওঠে। এ বিষয়গুলোকে শিক্ষার্থীদের
মধ্যে বাস্তবায়ন করার জন্য ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলোতে সহ-পাঠ্যক্রমগুলোকে বেশ প্রাধান্য
দেওয়া হয়।
নবম শ্রেণি
শেষ করার পর ৩ বছর মেয়াদি একটি কোর্স সম্পন্ন করতে হয় তাদের। এই কোর্সটা সম্পূর্ণ ক্যারিয়ার
ভিত্তিক। যে যেদিকে ক্যারিয়ার করতে চায় সে সে বিষয়ে কোর্স সম্পন্ন করে। এই কোর্স শেষে
তাদের একটি পরীক্ষা দিতে হয়। এই পরীক্ষার ভিত্তিতে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা
যাঁচাই করা হয়।
জাপানে
চতুর্থ শ্রেণির আগে বাৎসরিক, সাময়িক পরীক্ষা নেওয়া হয় না। বরংচ এই প্রথম তিন শ্রেণিতে
অংশগ্রহণ মূলক ছোট ছোট টেস্ট এবং তাদের শিষ্ঠাচারের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। জাপানে মনে
করা হয় এই বয়সে বাচ্চাদের জ্ঞান ও শিক্ষাকে যাচাই করার চেয়ে শিষ্ঠাচার শিক্ষা দেওয়া
উত্তম।
আমরা অহরহ
টিভিতে দেখে থাকি জাপানি মানুষরা কতটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কারণটা আর কিছু নয় জাপানের
স্কুলে কোন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মী থাকে না। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই দায়িত্ব ভাগ
করে সারা বছর স্কুল পরিষ্কার করার দায়িত্ব নিয়ে থাকে।
জাপানেও
হাইস্কুল শেষ করার পরে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য একটা পরীক্ষা দিতে হয়। জাপানি ভাষায়
সে পরীক্ষাকে বলা হয় এসকেনজিগোকু বা নরক পরীক্ষা। এই পরীক্ষাটা অনেক কঠিন। এজন্য জাপানি শিক্ষার্থীরা তাদের ক্লাসের পরেও অতিরিক্ত
কোচিং করে থাকে এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য। এই পরীক্ষার ভিত্তিতে জাপানে শিক্ষার্থীরা
বিশ্ববিদ্যালয় অথবা টেকনিক্যাল স্কুল বেঁছে নিতে পারে।
খুব ভালোভাবে
খেয়াল করলে দেখা যাবে, ফিনল্যান্ড আর জাপানে শিশুদের উপর চাপ প্রয়োগ না করার ব্যাপারে
একই পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। ছোট্ট বয়সটাতে পড়ার চাপ দিয়ে নয় হেসে খেলে তাদের শেখাতে
হবে। এতে তাদের শিশুকাল ভালো কাটে আর আস্তে আস্তে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়।
এই পদ্ধতি
ব্যবহার করে ফিনল্যান্ড ও জাপান শিক্ষার মানে সেরাদের মধ্যে অবস্থান করছে। আর এটা নিশ্চিত
করেছে অনেক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিখ্যাত সংবাদ পত্রের রিপোর্ট এবং আন্তর্জাতিক
শিক্ষার মান যাচাইকরণ প্রতিযোগিতা পিসা স্টাডি। পিসা স্টাডি পরিচালিত হয় ওইসিডি (দ্য
ওর্গানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভোলপমেন্ট) দ্বারা। ২০০০ সালে থেকে
তিন বছর পর পর অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতা কয়েকটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক দক্ষতা
যাঁচাই করে এবং তার ফল প্রকাশ করে।
২০১৫ সালে
পিসার ফলাফল অনুযায়ী বিজ্ঞান, পড়া এবং গণিত বিষয়ে জাপান দ্বিতীয় স্থানে আর ফিনল্যান্ড
পঞ্চম স্থানে অবস্থান করছে। বিজ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস, লেগে থাকা এবং প্রেরণা বিষয়ে
জাপান দ্বিতীয় স্থানে আর ফিনল্যান্ড পঞ্চম স্থানে অবস্থান করছে। শিক্ষা সমতা বিষয়ে
জাপান দ্বিতীয় স্থানে আর ফিনল্যান্ড পঞ্চম স্থানে অবস্থান করছে। সহযোগিতামূলক সমস্যা
সমাধান বিষয়ে জাপান দ্বিতীয় এবং ফিনল্যান্ড সপ্তম স্থানে অবস্থান করছে।
জাপানে একটা প্রবাদ আছে- এক হাজার দিন কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশুনা করার চেয়ে প্রতিভাবান
একজন শিক্ষকের কাছে একদিন থাকা উত্তম। প্রবাদটা জাপানের হলেও মানে ফিনল্যান্ডও। শিক্ষক
নিয়োগের ব্যাপারে ফিনল্যান্ড ও জাপান উভয়ই খুব সতর্ক। ফিনল্যান্ডে মাস্টার্স পাস ব্যতীত
প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দেওয়া যায় না। এই শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা কয়েকটি ধাপে
হয়ে থাকে এবং দেশের সেরা মেধাবীদেরই শুধু এই পেশায় সুযোগ দেওয়া হয়। শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ
পাওয়ার পরপরই তাদের ক্লাস রুমে ছেড়ে দেওযা হয় না। এর আগে তাদের কয়েক বছরের ট্রেইনিং
হয় এবং সে ট্রেইনিং শেষ হবার পরই তারা ক্লাস রুমে ঢোকার সুযোগ পায়।
জাপানের
ক্ষেত্রে বিষয়টা আরো অনেক কঠিন। জাপানে যারা শিক্ষকতা করতে চান তাদের বিশ্ববিদ্যালয়
ডিগ্রির প্রয়োজন হয় (কমপক্ষে অনার্স)। এরপর কয়েকটি ধাপে তাদের পরীক্ষা দিতে হয়। এই
পরীক্ষাতে পাস করলেই তাদের শিক্ষকতার সুযোগ দেওয়া হয় না। যারা মেধা তালিকায় প্রথম
দিকে থাকে তাদের আগে সুযোগ দেওয়া হয়। শিক্ষক
হিসেবে যোগদান করার পর এক বছর তাদের একজন সিনিয়র শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে কাজ করতে হয়।
এই এক বছরের প্রবেশন শেষ করার পর তারা স্থায়ী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান।
এই দুটো
দেশের শিক্ষা ও শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিকে পুঁজি করে আমাদের দেশের শিক্ষা পদ্ধতির উন্নয়নে
আমাদের যে বিষয়গুলো গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন-
শিশুদের
শিখনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব।
মার্কের চেয়ে
কী শিখছে তার উপর গুরুত্ব।
ছোট
শ্রেণিগুলোতে শিষ্ঠাচারের শিক্ষা দেওয়া।
শিশুদের জন্য
খেলাচ্ছলে শিখানো পদ্ধতি প্রয়োগ করা।
পরীক্ষার চাপ
কমানো।
পঞ্চম শ্রেণি
পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কম ক্লাস রাখা।
সর্বোচ্চ
মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া।
ট্রেইনিং শেষ
হওয়ার পরই নতুন শিক্ষকদের শ্রেণি কক্ষে পাঠানো।
শিক্ষকদের
আত্ম উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় বরাদ্দ রাখা।
শিক্ষকদের জন্য
কম ক্লাস রাখা।
শিক্ষক ও
শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত পাঠ্যক্রম এর প্রতি অন্তর্ভূক্ত করা।
শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান সময় কাটানোর শ্রেষ্ঠ
স্থান এই পরিবেশ
তৈরি করা।
Bangla Short Film