“তুমি কোন দেশি?” ‘আমি বাংলাদেশি’। “ও, ড. ইউনুস এর দেশ। খুব ভাল।” কিছু বোঝা গেল? বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। তারপরেও বাংলাদেশের পরিচয় এর সন্তান দিয়ে। ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশের অপর নাম সাকিব আল হাসান। ঠিক তেমনই ক্যামব্রিজ ইউনিভার্টিতে বাংলাদেশ মানে ড. তৌফিক হাসান।
নাম শোনেননি নিশ্চয়ই!!! না শোনারই কথা, এ ধরনের মানুষদের কথা আমাদের মিডিয়ায় যে আসেনা। কিন্তু তারাই আমাদের মিডিয়া হয়ে দেশের নামকে ছড়িয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। ওয়েবে হিট হচ্ছে বাংলাদেশ!!
নাম শোনেননি নিশ্চয়ই!!! না শোনারই কথা, এ ধরনের মানুষদের কথা আমাদের মিডিয়ায় যে আসেনা। কিন্তু তারাই আমাদের মিডিয়া হয়ে দেশের নামকে ছড়িয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। ওয়েবে হিট হচ্ছে বাংলাদেশ!!
ড. তৌফিক হাসান। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ইলেকট্রনিক ম্যাটারিয়াল এন্ড ডিভাইস বিষয়ের একজন লেকচারার। এ ডিপার্টমেন্টেরই
একটি অংশ ‘গ্রাফিন সেন্টার’। সেখানে তিনি মাস্টার অফ রিসার্চ প্রোগ্রামের পরিচালক। এবং ডকটোরাল ট্রেইনিং সেন্টারে টিচিং এন্ড ট্রেইনিং সেকশনের সহকারি পরিচালক।
এছাড়াও এ সেন্টারের ন্যানো ম্যাটেরিয়ালস এন্ড স্পেকট্রোসকপি গ্রুপে ‘রয়্যাল একাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং’ রিসার্চ ফেলো হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। কোন বাংলাদেশি হিসেবে এ পদে এবং দায়িত্বে তিনিই প্রথম।
এছাড়াও এ সেন্টারের ন্যানো ম্যাটেরিয়ালস এন্ড স্পেকট্রোসকপি গ্রুপে ‘রয়্যাল একাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং’ রিসার্চ ফেলো হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। কোন বাংলাদেশি হিসেবে এ পদে এবং দায়িত্বে তিনিই প্রথম।
শুধু এতটুকু পরিচয়ের মধ্যে তাকে সীমাবদ্ধ করলে অবিচারই করা হবে। তিনি একাধারে শিক্ষক, গবেষক এবং বিজ্ঞানী। তিনি কত বড় একজন মানুষ তা তার বর্তমান কাজের উপর কিছুটা ধারণা করা যায়। তার কাজের ক্ষেত্র গ্রাফিন নিয়ে।
গ্রাফিনকে বলা হয় মিরাকল ম্যাটারিয়াল। উন্নত বিশ্বে এর ব্যবহার ত্বরান্বিত করার জন্য ব্যাপকভাবে গবেষণা চলছে। গ্রাফিন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, চীনের মত রাষ্ট্রসমূহ। দেরিতে হলেও যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য রাষ্ট্রও এ গবেষণায় বিনিয়োগ করছে।
এই গ্রাফিন এর উপর ভিত্তি করে ড. হাসান নমনীয় এবং মুদ্রণযোগ্য
ডিভাইস নিয়ে কাজ করছেন।তার মধ্যে ন্যানো ম্যাটেরিয়াল কালি অন্যতম। এ কালি প্রিন্টিং জগতে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন
করবে। এ পরিবর্তনের
সাফল্যের সর্বনিম্ন মাত্রা হবে- প্রিন্টিং খরচ
এবং সময়
অর্ধেকে নেমে আসবে!
ড. তৌফিক ১৯৭৯ সালে বাগেরহাট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা বিএডিসি’র রিটায়ার্ড ইঞ্জিনিয়ার। মা বাংলা সাহিত্যের শিক্ষিকা ছিলেন। ভাই বোনও থাকেন দেশের বাহিরে। ভাই ওমান সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে মেডিকেল অফিসার হিসেবে দায়িত্বরত। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসি বোন, কাজ করেছেন আইবিএম এর প্রোগ্রামার হিসেবে।
পথ পরিক্রমার একটা মজার ঘটনা আছে। তখন ছিল বোর্ড স্ট্যান্ড এর যুগ। প্রতি বোর্ড থেকে ২০ জন সেরা শিক্ষার্থী স্ট্যান্ড করত। তিনি বরাবরই ভাল ছাত্র ছিলেন। তার মায়ের প্রত্যাশাও ছিল তাই একটু বেশি। আশা ছিল তিনি সেরাদের প্রথম দিকেই থাকবেন। এ খবর পেয়ে সাংবাদিকরা আসবে।
এজন্য এস.এস.সি রেজাল্টের দিন সুন্দর করে ঘরদোরও গুছিয়ে রেখেছিলেন সাংবাদিকদের জন্য। তবে মাকে হতাশ করে দিয়ে তিনি একটু খারাপ রেজাল্ট করলেন! হলেন বোর্ডে এগারতম! সাংবাদিকরা আসলেন না। বৃথা গেল মায়ের প্রচেষ্টা!
ড. তৌফিক বললেন, “ঐ খারাপ রেজাল্টই আমাকে এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে। কারণ আশাতীত রেজাল্ট না হবার জন্য আমি এইচ.এস.সি লেভেলে অনেক পরিশ্রম করি। এস.এস.সিতে ইংরেজিতে খারাপ হওয়ায় আমি তাতে অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে গুরুত্ব দেই। পরিশ্রম বিফলে যায়নি। মায়ের ইচ্ছা পূরণ করে আমি বোর্ডে প্রথম হয়েছিলাম। তারচেয়েও বড় কথা ইংরেজিতে ভাল হওয়ার কারণে আমার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ও কৃতিত্বের সাথে শেষ হয়েছিল।”
তিনি ইলেকট্রিকাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ইসলামিক
ইউনিভার্সিটি অফ
টেকনোলজি, বাংলাদেশ থেকে বি.এস.সিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন এবং ও.আই.সি’র স্বর্ণপদক লাভ করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটিতে মাইক্রো ইলেক্ট্রনিক্স এ স্কলারসিপ পেয়ে এম.এস.সি করতে চলে যান। সেখান থেকে তিনি ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির অধিনে পি.এইচ.ডি করার সুযোগ লাভ করেন।
ড. তৌফিক এর সাথে বিডি ইয়ুথ টিমের আলাপচারিতার একটা বড় অংশ ছিল তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে। তাদের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে নীতি নির্ধারণ, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণ এবং স্বপ্ন নিয়েও আলোচনা উঠে আসে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন,“ রাষ্ট্রের পলিসি মেকিং একটা বড় জিনিস। রাষ্ট্রের দায়িত্ব থাকে তাদের ভবিষ্যতকে গড়ে দেওয়ার। কিছু নাহলেও অন্তত সাহায্য করার। এদেশের তরুণরা কাজের জন্য যে পরিমাণ বাইরে যায় সে পরিমাণ যদি পড়াশুনার জন্য যেত তাহলে বাংলাদেশ আজ কোথায় থাকত!”
তিনি আফসোস করে বলেন,“এটা খুবই দুঃখজনক যে ক্যামব্রিজের মত যায়গায় এ ফিল্ডে শুধু আমি একা। যেখানে অন্যদেশের ক্ষেত্রে একাধিক
জন রয়েছে। শুধু তাই নয়, এ ছোট্ট কর্মজীবনে আমার অধীনে একজনও বাংলাদেশী শিক্ষার্থী নেই।”
তিনি আরো বলেন, “বাংলাদেশীদের সবচে বড় সুবিধা হল তারা যেকোন পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে। সাথে পরিশ্রম করার মন-মানসিকতা তৈরি হলে হবে সোনায় সোহাগা।” বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা কেন উচ্চতর পড়াশুনা বা গবেষণায় কম সুযোগ পাচ্ছে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এতে আসলে তরুণদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমরাই হয়ত তাদের সুযোগ দিচ্ছিনা বা গাইড করছিনা। পথ চিনিয়ে দিলে অবশ্যই তারা সক্ষম হবে।”
শুধু একথা বলেই তিনি থেমে জাননি। বিডি ইয়ুথ এর মাধ্যমে পড়াশুনার উদ্দেশ্যে সকল বিদেশ গমনেচ্ছুদের পরামর্শও দিয়েছেন
তিনি। তিনি বলেন, “অনেকেই হায়ার স্টাডিজের জন্য ইউনিভার্সিটি গুলোতে আবেদন করে। এটা পুরনো পদ্ধতি। আধুনিক পদ্ধতি হল সরাসরি অধ্যাপক বা তত্ত্বাবধায়ক এর সাথে যোগাযোগ করা। হায়ার স্টাডিজ এর সময় আমি বেছে বেছে আমার পছন্দের বিষয়ে ১৫০ জনেরও অধিক সুপারভাইজ বা অধ্যাপক এর কাছে ই-মেইল করেছিলাম।”
“যার কাছে ই-মেইল করছি তার কাজ সম্পর্কে আমার ধারনা থাকা চাই। নাহলে সুপারভাইজর মনে করতে পারেন আমি তার কাজ সম্পর্কে সেরকম গুরুত্ব দিচ্ছিনা। এরপর আমি কোন বিষয় নিয়ে কাজ করতে চাই তার বর্ণনা দিব। যে কাজ আমি পারি এবং যে কাজ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা আছে শুধু সে বিষয়টাই লিখব।”
“পাবলিকেশন থাকলে ভাল। পাবলিকেশন এর মধ্যে অনেক ধরন আছে। যে সমস্ত পাবলিকেশনস কোম্পানি লেখকদের কাছে পাবলিকেশন ভিক্ষা করে সে সমস্ত পাবলিকেশন উল্লেখ করা উচিৎ নয়। এতে সুপারভাইজরদের নেতিবাচক ধারনা তৈরি হয়। ফার্স্ট বা সেকেন্ড অথোর হলে বিষয়টা সম্পর্কে আরো ভাল করে পড়াশুনা করতে হবে। কারণ এ বিষয়ে অবশ্যই ভাইভা নেওয়া হবে।”
“সুপারভাইজররা অনেক সময় তোমাদের ই-মেইল দেখে খুশি হলে অনলাইনে ভাইভা নিতে পারেন বা প্রপোজাল পাঠাতে বলতে পারেন। কোন অবস্থাতেই কোন ধরনের অজুহাত দেওয়া যাবেনা যে, ‘আমার আরো সময় লাগবে’ বা ‘এ বিষয়টা আমাদের পড়ানো হয়নি’। বরং যা করতে বলবে সে সম্পর্কে একটু পড়াশুনা করে ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ভুল হলে তিনিই বলবেন, ‘এটা হয়নি।’ তাকে বুঝাতে হবে তুমি পরিশ্রম করতে রাজি আছ।”
“হায়ার স্টাডিজে বিদেশে পড়ার ইচ্ছা থাকলে আন্ডার গ্রাজুয়েট বা তার আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। রেজাল্ট অনেক সময় বড় ফ্যাক্টর। সেরা পাঁচের ভিতর থাকতে পারলে স্কলারশিপের ক্ষেত্রে সুবিধা হয়। কারণ অধিকাংশ সুপারভাইজাররাই ধরে নেন, যারা সেরা পাঁচের মধ্যে থাকে, তারা পরিশ্রমী হয়। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লাম সেটা বড় ব্যাপার নয়।”
আড্ডাও প্রায় শেষ হয়ে আসছিল। শেষ মূহুর্তে প্রশ্ন করা হয়, দেশের ব্যাপারে কি ভাবছেন? উত্তরে তিনি লাজুক হেসে বলেন, “এটা তো অনেক বড় বিষয়। আমার মত ছোট মানুষের পক্ষে এত বড় বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা আসলে কঠিন।”
দেশে ফেরার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ আমার যে কাজের
ক্ষেত্র
তা বাংলাদেশে প্রয়োগ কম। রয়েছে গবেষণা বরাদ্দের অভাব। আমি অবশ্যই দেশের জন্য কিছু করতে চাই। কিন্তু সে সুযোগ কি দেশ আমাকে দিবে? একজন গবেষকের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন নিরবিচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করা। এ সুযোগ যদি তৈরি হয় অবশ্যই দেশে আসব।”
সন্তান হিসেবে
দেশকে এগিয়ে নিতে দেশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “রেমিটেন্স আয় থেকে
১০০ কোটি টাকা খরচ করে
তা দিয়ে যদি ১০০ জন মেধাবিকে
দেশের
বাইরে পড়াশুনার জন্য পাঠানো
যায় এবং পড়া শেষে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে এদেশ অবশ্যই কিছুকাল পর এর সুবিধা ভোগ করবে। অন্যকারো কাছ থেকে ধার করা নয়, নিজস্ব প্রযুক্তি গড়ে উঠবে। এ জাতি হবে আত্মনির্ভরশীল জাতি।”
বিঃদ্রঃ- আমার এ লেখাটি বিডিইয়ুথ.কমে প্রকাশিত হয়েছিল। এটার কপিরাইট তাদেরই। আমি শুধু পোর্টফোলিও তৈরির জন্য অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করছি।
Comments
Post a Comment