হাফেজ হাসান হাফিজ। কর্মের সন্ধানে
২০০৭ সালে সরকারিভাবে মালয়শিয়ায় আসেন। সে হিসেবে মালয়শিয়াতে তার অনেকগুলো ঈদ ও
রমজান কাটানো হয়েছে। বর্তমানে সেখানকার একটি জামে মসজিদে ইমামের দায়িত্ব পালন
করছেন।
সেখানে বিয়েও করেছেন এবং তিনি দুই পুত্র সন্তানের জনক।
প্রথম জীবনের কিছু কষ্টের স্মৃতি, এখনকার দিনকাল ও মালয়শিয়ার লোকজন সম্পর্কে
পর্যবেক্ষণ সবকিছু মিলিয়েই তিনি বিডি ইয়ুথের পাঠকদের জন্য তার কথা বলার চেষ্টা
করেছেন। চলুন শুনে আসি তার মুখ থেকেই।
প্রথম ঈদের স্মৃতি
এবং বাংলাদেশের মর্ম বোঝা
২০০৭ সালে মালয়শিয়ায় কাজের সন্ধানে আসা।
প্রথমে এসে কাঠ এবং গ্লাস সম্পর্কিত কাজ পাই। কিন্তু আমার ইচ্ছা ছিল মসজিদে
খেদমত করার। তখন থেকেই খোঁজ রাখতাম যে মসজিদে কোন খেদমতের সুযোগ পাওয়া যায় কিনা।
কিছুদিন পরে সে সুযোগ এসে গেলো।
একটি পাঞ্জেগানা (যেখানে শুধু পাঁচ
ওয়াক্ত নামাজ পড়ানো হয়, জুমআর নামাজ নয়) মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব পাওয়া গেলো। সে
মসজিদে অন্য জামে মসজিদের মুসল্লিরাও নামাজ পড়তে আসতো। পরে তারা আমাকে পছন্দ করে
জামে মসজিদে নিয়ে গেলো। ২০১০ সাল থেকে সে মসজিদের দায়িত্বেই আছি।
জীবনের প্রথম ঈদ করাটা খুব কষ্টের
ছিল। ভাই ভাই মিলে কোলাকুলি করাটা খুব মিস করেছি। ঐ কষ্ট ভোলার জন্য মালয়শিয়া আমি
যে এলাকায় ছিলাম ঈদের দিন (সুঙগাইবুলো) ঐ এলাকার গ্রামের দিকে খালি পায়ে হাঁটতে
থাকলাম।
হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। তখন
আমি একটি বাড়ির ছাউনির নিচে আশ্রয় নিয়েছিলাম। স্বাধারণত বাংলাদেশ হলে ডেকে জিজ্ঞেস
করতো বা বাড়িতে ডেকে খাওয়াতো। কিন্তু অবাক লাগলো বাড়ির লোকজন আমাকে দেখেও কিছু
বললো না। অথচ সে বাড়িতে তাদের পরিচিত জনেরা আসা যাওয়া করছিল।
তখন ভাবছিলাম এরা এত শক্ত হৃদয়ের কেন?
তখন বুক ফেঁটে কান্না পাচ্ছিল। নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। তখনই নিজের দেশ ও মানুষ
এর মর্ম বুঝলাম। বুঝলাম বাংলাদেশের মতো অতিথিপরায়ণ দেশ আর কোথাও নেই। আর আল্লাহর
কাছে শুকরিয়া জানালাম আমাকে বাংলাদেশে জন্ম দিয়েছেন বলে।
তবে এদেশের সব জিনিস যে ভালো তা নয়।
এখানে হরতাল, ভাঙচুর এর মতো জিনিসগুলো আমাদের দেশের মতো হয় না। এখানে সে কালচারটাও
গড়ে উঠেনি। এদেশের সাথে আমাদের দেশের অনেক পার্থক্য আছে। এখানে যারা বিয়ে করেছে বা
করেনি সবার জন্যই এটা প্রযোজ্য। বিয়ের কথা এজন্য বললাম যে, আমাদের দেশে জামাই আদর
বলে একটা জিনিস আছে। শালা-শালি বা শ্বশুর বাড়ির সাথে অন্য রকম একটা সম্পর্ক থাকে।
কিন্তু এটা এখানে কম।
সেদিক থেকে আমাদের দেশের সম্পর্কের মজাটা অন্য রকম।
হাসান হাফিজের
মালয়শিয়ান বিয়ে
মানুষ যখন বয়ঃপ্রাপ্ত হয়, তখন থেকেই
একটা রঙিন স্বপ্ন কাজ করে। জীবন সঙ্গীর স্বপ্ন। খুবই স্বাভাবিক কিন্তু একটি
অসাধারণ বিষয়। আমার বেলায়ও সেটা হয়েছে। তবে বেশ ব্যতিক্রমই বলতে হবে।
আমি যে মসজিদে বর্তমানে আছি, এখান
থেকেই আমার জন্য এদেশ থেকে বেশ কয়েকটা প্রস্তাব আসে। আমাদের দেশের সংস্কৃতি
অনুযায়ী, আমি আমার গুরুজনদের সাথে পরামর্শ করি। আমার মা বেঁচে থাকতে একটা কথা
বলতেন, “সব সময় বড়দের কাছ থেকে পরামর্শ নিবে। দেখবে তাদের পরামর্শগুলো থেকে তুমি
সুন্দর একটা সমাধান পাবে।”
মার কথা বিফলে যায়নি। আমার স্ত্রীর
পরিবার থেকে যখন প্রস্তাব আসলো তখনও আমি সবার সাথে পরামর্শ করলাম। দেশে আমার
আত্মীয়দের কাছ থেকে, এখানে আমার গুরুজন
শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে। সবাই আমার স্ত্রীর ব্যাপারে মত দিলো। আমিও
আল্লাহর উপর ভরসা করে বিবাহের পক্ষে সায় দিলাম।
বিবাহ স্থানীয় রীতিতে সম্পন্ন হলো।
বিয়ের আগে মোহরানা বাবাদ ১০ হাজার রিংগিত (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২ লাখ) কনেকে
প্রদান করলাম। প্রায় ৫ বছরের সংসার জীবনে স্ত্রী হাজ্জাহ হুমাইরা আর দুই ছেলে
আব্দুর রহমান ও ত্বহাকে নিয়ে বেশ সুখেই আছি।
এবার এলো রমজান
এখানকার মানুষজন রমজানটা একটু অন্য
রকমভাবে পালন করে থাকে। এদেশে রমজানকে স্থানীয় ভাষায় ‘পুয়াসা’ বলা হয়।
অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো এখানেও চাঁদ দেখা কমিটি আছে। রমজানের চাঁদ দেখা গেলে তা
এদেশের সুলতানকে জানানো হয়। এবং সুলতান সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়ার পরপরই রমজান পালন
শুরু হয়।
রমজানের চাঁদ দেখা গেলে সবাই
মসজিদের সামনে সমাবেত হয়ে আল্লাহর প্রশংসামূলক ধ্বনি দেয়। এ প্রশংসা ধ্বনি
অনেকক্ষণ ধরে চলতে থাকে। প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত। মসজিদ এবং বাসায় একই ভাবে এ
ইবাদাতটি চলতে থাকে। যারা এ প্রশংসা স্তুতি গায় তাদেরকে বয়োবৃদ্ধরা বখশিসও দিয়ে
থাকেন।
মালয়শিয়ার সাপ্তাহিক ছুটি রবিবার।
রমজানের আগে যে রবিবারটা পড়ে সেদিনে ওখানকার মানুষ সবাই মিলে তাদের এলাকার জামে
মসজিদ পরিষ্কার করার কর্মসূচি গ্রহণ করে।
মসজিদ প্রাঙ্গন থেকে শুরু করে
থালাবাসনও পরিষ্কার করে থাকে। এ কাজটাকে স্থানীয় লোকজন ‘গুতোং রুয়োং’ (Work Together) বলে থাকে।
ব্যাপারটা এমন নয় যে সেসব মসজিদে খাদেম নেই। বরং তারা এ কাজটাকে আনন্দের সাথে করে
থাকে।
ইফতার যেভাবে করা হয়
আমাদের দেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির মতো
এখানেও ধনী গরীব একসাথে ইফতার করে এবং স্বপরিবারে। রমজানের একেক দিন
একেকজন ধনী মসজিদে সম্পূর্ণ ইফতারের দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। তবে অনেক সময় এখানে বসবাসরত বাঙালিরাও
একদিন সমবেতভাবে মসজিদের সম্পূর্ণ ইফতারির ব্যবস্থা করে থাকেন।
ইফতারে খেজুর আর পিঠা বেশি থাকে। ‘বুবর’
এখানে কমন খাবার। জিনিসটা অনেকটাই আমাদের দেশের হালিমের মতো। তবে রঙটা সাদা হয়,
আমাদের মতো হলুদ হয় না।
অধিকাংশ মসজিদেই ইফতারের সময় হলে
প্রথমে হালকা খাবার তারপর নামাজের পর ভারি খাবার দেওয়া হয় অথবা নামাজের আগেই হাল্কা
আর ভারি খাবার একত্রেই দেওয়া হয়। কোন কোন জায়গায় তারাবিহ নামাজের পরও হাল্কা
নাস্তার ব্যবস্থা থাকে। আবার কোন মসজিদে শেষ পনের দিন থেকে সাহরিরও ব্যবস্থা থাকে।
মসজিদের পক্ষ থেকে রমজানের
দরিদ্র সহায়তা প্রোগ্রাম
সারা বছর জুড়ে বিশেষ করে রমজান মাসে
গরীব-দুঃখীদের জন্যে এলাকায় এলাকায় জোট বেঁধে সাহায্য টিম গঠন করা হয় এবং তাদের
সাহায্য করা হয়। তারা বাড়িতে বাড়িতে যেয়ে খোঁজ খবর নেয় এবং তাদের অবস্থা অনরূপ
সাহয্যের ব্যবস্থা করে।
এটা মসজিদেরই একটা কার্যক্রম।
প্রত্যেক এলাকার মসজিদ গুলোতে সে সব এলাকার মানুষদের লিস্ট থাকে। এবং সে লিস্ট
অনুযায়ীই যার যা সাহায্য প্রয়োজন সেটা বাড়িতে চলে যায়। কাউকে সাহায্য চাওয়ার জন্য
আসতে হয় না।
আর্থিক সাহায্য ছাড়াও খাদ্য
দ্রব্যেরও ব্যবস্থা করা হয়। আশ্চর্জের বিষয় হলো এ কার্যক্রমে শুধু মুসলিমরাই না,
অন্য ধর্মের লোকেরাও অংশ গ্রহণ করে! এবং
সবাই এ জন্য মসজিদ প্রাঙ্গনেই সমাবেত হয়!!!
ঈদের নামাজ যেভাবে
পড়ে
আমাদের দেশের মতোই এখানে ঈদের
নামাজের আধা ঘণ্টা বা একঘণ্টা পূর্বেই মুসল্লিরা মসজিদ ও ঈদগাহে উপস্থিত হয়। নামাজের
পূর্বে এখানেও ইমাম সাহেব সমবেত মানুষদের উদ্দেশ্যে নসিহত পেশ করেন। এবং এখানকার
অধিকাংশ মুসলিমরা শাফেয়ি মাজহাবের হওয়ায় সে অনুযায়ী নামাজ পড়ানো হয়।
বিঃদ্রঃ- আমার এ লেখাটি বিডিইয়ুথ.কমে প্রকাশিত হয়েছিল। এটার কপিরাইট তাদেরই। আমি শুধু পোর্টফোলিও তৈরির জন্য অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করছি।
Comments
Post a Comment