Skip to main content

কসাইনামা


‘শালা একদম কসাই’ সুবোধ সাহেব মোবাইলে কথাটা বলতেই কসাই ভাই বলে উঠলেন, ‘যান আপনারে কাছে গোস্ত বেচমু না’। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন সুবোধ সাহেব। একটু ইগোতে লাগলো, আর একটু অপমানিত বোধ করলেন তিনি। পোড়া কপাল বলতে হবে তার। আজ আবার সাথে নিয়ে এসেছেন স্কুল পড়ুয়া ছেলেকে। তাই মাথার রাগ সপ্তমে চড়লেও নিজেকে ধীর রাখলেন তিনি। কল কেটে দিয়ে কসাইকে নরম সুরে বললেন, ‘কেন ভাই আমি আবার কী করলাম?’ কসাই ঝাঁজের সাথে জবাব দিলেন, ‘কসাই কইলেন কারে?’ কথাটা শুনে সুবোধ সাহেবের রাগ অট্টহাসিতে পরিণত হলো। অট্টহাসিতে কসাই চুপ মেরে গেলো। সে বোঝার চেষ্টা করছিলো এটা কোন জাতের ছাগল! আসলে ব্যাপার হলো কসাই ভাইয়ের দুনিয়াটা গরু-ছাগল নিয়ে। তাই তিনি এর বাইরে কিছু ভাবতে পারেন না। তার ভাবনাটার দোষ দিয়ে লাভ নেই। যাইহোক, কসাই ভাইয়ের ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে সুবোধ সাহেব বললেন ‘আরে ভাই আপনাকে বলি নাই তো। আমাদের এলাকার এক ডাক্তারকে গালি দিয়েছি।’ কসাই ভাই ছিলেন একটু খোঁজ খবর রাখা লোক, তাই ভাই সাহেবের কথাটা বুঝলেন। আর বললেন, ‘আগে কইবেন তো! আমি তো মনে করলাম আমারে কইছেন! লন আপনার গোস্ত। আপনার জন্য কেজিতে ১০ টাকা কম রাখলাম। আবার আইসেন।’

সুবোধ সাহেব ব্যাপারটা ট্যাকেল দিতে পেরে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। ছেলের সামনে ইজ্জতটা একবারে যেতে চলেছিল প্রায়। কিন্তু নিজের বুদ্ধিমত্তা আর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার জন্য বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন বলে মনে মনে বাহবা দিলেন নিজেকে। বাজার করা শেষ, তাই রিক্সা ডাকলেন। ছেলেকে আগে রিক্সায় উঠালেন। তারপর বাজার সদাই এর ব্যাগ রাখলেন। সবশেষে রিক্সা ওয়ালা আর ছেলের সাহায্যে নিজে উঠলেন। সুবোধ সাহেব নিজের ছেলেকে খুব ভালোবাসেন। করোনার সময়ে ছেলেকে বাজারে আনতে চাননি। কিন্তু হঠাৎ করে তার কোমরে ব্যথা বাড়ায় ছেলেকে সাথে আনেন। আবার ছেলেকে একা বাজারে পাঠাতে তার মনে সায় দেয়নি। এই ছেলেকে নিয়ে তার বড় আশা। সুবোধ সাহেবের ছেলে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে। ডাক্তার বানাতে চান তাকে, কসাই না!

ছেলের দিকে পরম স্নেহে তাকিয়ে এ রকম সাত-পাঁচ ভাবছিলেন তিনি। হঠাৎ, ছেলের কথায় ভাবনা ছাড়লেন তিনি। সুবোধ সাহেবের ছেলের নাম কল্যাণ। মানুষের কল্যাণ করবে এ ভাবনা থেকে ছেলের নাম ‘কল্যাণ’ রেখেছিলেন তিনি। কল্যাণ সুবোধ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা ডাক্তারকে কসাই বলে কেন?’। সুবোধ সাহেব কল্যাণের প্রশ্নে একটু দ্বিধায় পড়ে গেলেন। কারণ তার উত্তরের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। নেচিবাচক উত্তর দিলে কল্যাণ ডাক্তারি পড়ার আগ্রহ হারাবে। অন্যদিকে ইতিবাচক উত্তর দিলে নিজের প্রেসটিজ পাংচার হয়ে যাবে। কারণ একটু আগেই ডাক্তারকে কসাই বলে গালি দিয়েছেন তিনি। তার সাক্ষী স্বয়ং কল্যাণ। সুবোধ সাহেব বয়স কালে ভালো ব্যাটসম্যান ছিলেন। এজন্য বাউন্সার খেলা তার অভ্যাস আছে। তিনি বললেন, ‘বাবা সব ডাক্তারই কসাই না। কিছু কিছু ডাক্তার কসাই এর মতো। সবাই তো আর খারাপ না।’ এবার কল্যাণ বললো, ‘ বাবা আমার প্রশ্ন ছিল কসাই কেন বলে? কসাইরা কি খারাপ? এই উপমা কেন ব্যবহার করে?’ সুবোধ সাহেব ভালো ব্যাটসম্যান থাকলেও কিছু বোলারকে তিনি বুঝতে পারতেন না। বিশেষ করে দুসরা, ক্যারাম, গুগলি টাইপের বল খেলতে তার খুব সমস্যা হতো। এটা ছিল গুগলি টাইপের বল। খুব কষ্ট করে ডিফেন্ড করলেন। কল্যাণকে বললেন, এর উত্তর আমার জানা। কিন্তু তোমার কী মনে হয়? তোমার উত্তরটা আগে শুনে দেখি।

কল্যাণ ক্রিকেট ভালো খেলতে পারে না। তবে ক্রিকেট সে ভালোই বোঝে। কল্যাণ বললো, ‘বাবা, কসাই কেন বলে সেটা আমারও প্রশ্ন। কসাই এর কাজ পশু জবাই করা। একটু পরিষ্কার করে বললে গরু-ছাগল বা এ ধরনের পশু তারা জবাই করে। চামড়া ছাড়ায়। আর আমাদের খাওয়ার উপযোগী করে বিক্রি করে। এটা তার কাজ বা পেশা। এ কাজটাতে খারাপ কিছু দেখি না। যদি পশু জবাই করে বিক্রি খারাপ বলতেই হয় তবে আমাদেরও রাক্ষস বা দানব বলতে হবে। কারণ ওরা কাটে, আমরা খাই।

ডাক্তারি করা একটা পেশা। তারা তাদের কাজ করে। কাজ করতে যেয়ে তাদেরও ভুল হয়। কারণ তারা দেবতা বা ফেরেশতা তো নয় যে ভুল হবে না বা মুহূর্তেই রোগ সারিয়ে দিবে। তারা রোগীকে অপারেশনে নেওয়ার আগে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে কনসেন্ট ফর্মে সাইন এজন্যই নেয় যে তাদের হাতে জীবন-মৃত্যুর ব্যাপার থাকে না। তাদের শত চেষ্টা করার পরও রোগী মারা যেতে পারে। আমরা ঝুঁকির বিষয়টা জেনে বুঝে সাইন দেই আর রোগীর কিছু হলে ডাক্তারকে পিটাই বা কসাই বলি। আমরা জানি রোগী ঠিক হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। তারপরেও ডাক্তারের কাছে যাই। কেন যাই? নিজেরা নিজেদের ঠিক করতে পারি না বলে। নিজেদের অক্ষমতা তো আছেই। সাথে সাথে অনেক দোষও আছে। নিজেদের প্রতি নিজেরা যত্নবান হই না। এমনকি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরও তার প্রেসক্রিপসন মেনে চলি না। দোষটা আমাদের। কিন্তু আমরা দানবীর, দেওয়ার বেলায় ডাক্তারকেই যত দোষ দান করে দেই। আমরা স্বার্থপর না, তাই নিজেদের কখনও দোষ দেই না, অন্যদের বিলিয়ে দেই।

একটু আগে তুমি বলেছিলে সব ডাক্তারই খারাপ না। আসলেই কিছু ডাক্তার খারাপ আছে। এই খারাপটা অন্য পেশার বা সাধারণ মানুষের মধ্যেও আছে। তাহলে কয়েকজন খারাপ ডাক্তারের জন্য, ভুল হয়েছে তাদের ডাক্তার বলবো না। কয়েকজন খারাপ ব্যক্তির জন্য পুরো পেশাকে কেন এমন গালি দিতে হবে যাদের ভেতর কোন সাদৃশ্যই নেই। বাবা, আমি আসলেই জানি না ডাক্তারদের কসাই কেন বলে।’

সুবোধ সাহেব জীবনে অনেক বল খেলেছেন কিন্তু এই বলটা ঠিক কোন ক্যাটাগরির তা বুঝতে পারছেন না। একটু চিন্তা করলেন আর ভাবলেন, বর্তমানে অনেক ডাক্তার যে রোগীদের চিকিৎসা দিতে চাচ্ছে না, সে কথা বলবেন কি না। তারা যে যেকোন অবস্থায় মানব সেবার শপথ নিয়েছিলেন সেটাও কল্যাণকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু বিবেকবোধ তাকে বাধা দিলো। বিবেক বলতে লাগলো, ডাক্তার ছাড়াও আরো অনেকে তো অনেক রকম শপথই নিয়েছিলেন। তারা ডাক্তার সহ সব মানুষের সুরক্ষার শপথ নিয়েছিলেন। কিন্তু কাজের বেলায় সামান্য একটা মাস্ক পর্যন্ত ডাক্তারদের সরবরাহ করতে পারেননি। সেখানে ডাক্তারদের কতটা দোষ দেওয়া যায়। ডাক্তারদের আমরা কসাই বললেও তো তারা আমাদের মতই সাধারণ মানুষ। তাদের মৃত্যু হয়, তাদেরও পরিবার আছে। তারা আমাদের মতই ব্যথা পায়, আনন্দ লাভ করে। পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্টই তো তারা চেয়েছে, আর তো কিছু নয়। তাও আমরা দিতে পারলাম না। এটা তো আমাদেরই ব্যর্থতা। সুবোধ সাহেব ভাবলেন, এই সুবোধটা তার আগে কেন এলো না! যদি আসতো তবে তাকে তো কল্যাণের কাছে আর হারতে হতো না। ক্ষণেক পরে ভাবলেন, কল্যাণের কল্যাণে তার সুবোধটা যে হারায়নি এটাই বা কম কিসে!

ছবি কৃতজ্ঞতা- Olga Kononenko, unsplash.com

Comments

Popular posts from this blog

কেমন হওয়া উচিত আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা?

আমেরিকান বিখ্যাত উপন্যাসিক গেইল গুডউইনের বলেছিলেন, উত্তম শিক্ষাদান পদ্ধতি হলো- “এক চতুর্থাংশ প্রস্তুতি , তিন চতুর্থাংশ উপস্থাপনা”। আমেরিকার বিখ্যাত দার্শনিক ও শিক্ষা সংস্কারক জন ডিউয়ির মতে, “আমরা যদি আজকের শিশুদের গতকালের মতো করে পড়াই তাহলে আমরা তাদের আগামীকাল ছিনিয়ে নিলাম”। কিন্তু বাস্তবতা হলো বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই (বাংলাদেশ সহ) শিক্ষার ক্ষেত্রে এই দর্শনগুলো অনুপস্থিত। এমনকি খোদ আমেরিকাতেও এর বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায় না। গেইল গুডউইন এবং জন ডিউয়ি বোঝাতে চেয়েছেন শিক্ষার্থীদের শেখাতে গেলে শিক্ষকদের নিত্য নতুন পদ্ধতির চর্চা করতে হবে। এবং তা শিক্ষার্থীদের উপস্থাপন করার আগে নিজে ভালো করে রিহার্সল করে নিতে হবে। আর এগুলো না করলে আমাদের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ে যাবে, পড়ার আগ্রহ হারাবে।   দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশে পরিমাণকে গুণমানের চেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কতজন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়ে পাস করলো কিংবা জিপিএ ফাইভ পেলো এটাকে সফলতা বলে ধরে নেওয়া হয়। অথচ গুরুত্বের জায়গাটা হওয়া দরকার ছিল শিক্ষার্থীরা কতটা শিখতে পারছে তার উপর। এতে লাভটা হতো শেষে বা আসল জায়গায় এসে। প্রাথম

কিভাবে কাটাবো অবসর?

ব্যস্ততার এ জীবনে অবসর যেন এক অন্য গ্রহের শব্দ। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা সপ্তাহে অন্তত একবার এ শব্দটির মুখোমুখি হই। কিন্তু কর্মের মানুষ সময়টাকে কিভাবে অকর্মে কাটাবে তা একটা ধাঁধার বিষয়। অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অবসর সময়টা খুব বাজেভাবে কাটে। তাদের মনে হয় এরচেয়ে বরং অফিস বা ক্লাস থাকলেই ভালো হতো। এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন সবসময় চলে আসে, “কিভাবে কাটাবো অবসর সময়?” অবসর সময়টা ভালোভাবে কাটানোর দারুণ কিছু টিপস নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন। ঘুমের সাথে আড়ি অনেকে ছুটির দিনে শুধু ঘুমিয়েই কাটান । এখনকার জেনারেশন এটাকে বলে ‘কোপাইয়া ঘুমানো’। এ কাজটা কখনও করবেন না। ধরলাম, সারাটা সপ্তাহ আপনার উপর ধকল গেছে। কিন্তু তাই বলে সারাটি দিন শুধু ঘুমিয়ে কাটবেন? সারাটা দিন না ঘুমিয়ে, অন্য দিনের চেয়ে ঘণ্টা খানেক একটু বেশি ঘুমাতে পারেন সর্বোচ্চ। এতে পরের কর্ম দিবসেও অভ্যাসের কোন পরিবর্তন হবেনা। ঘরকুনো হতে মানা “সারা সপ্তাহ বাইরেই তো কাটাই, একটা দিনও কি বাসায় থাকবো না? পরিবারকে সময় দেবো না?” চিন্তা করে দেখুন, সারাটা সপ্তাহ আপনার এক স্থানেই কাটানো হয়। সেটা হোক অফিস কিংবা ক্যাম্পাস । এ দিনটাতে অন্য কোথাও

মাশরাফি বিন মর্তুজা: বাংলাদেশের আবেগ

তিনি দেশ সেরা বোলার কিনা তা বিতর্কের বিষয় । ব্যাটিংয়ের মূল স্তম্ভও তিনি নন। তিনি শুধু বল করার সময় বল করেন। মাঝে মাঝে দু একটা উইকেট পান। কখনো রান কম দেন, কখনও বা বেশি। ব্যাটেও মাঝে মাঝে দু একটা ছক্কা দেখা যায়। কি এমন করেন তিনি! দলে তার প্রয়োজনটাই বা কি? তিনি না থাকলে এমনকি ক্ষতি দেশের ক্রিকেটের? মাশরাফি সমোলচদের এ প্রশ্নগুলো থাকতেই পারে। কিন্তু তবুও তিনি বাংলাদেশের কোটি মানুষের ভালোবাসার, আবেগের বস্তু! ইনজুরিকে সাথে নিয়ে চলেন তিনি। পড়ে যান আবার উঠে দাঁড়ান। টিমের সদস্যদের সাথে করে নিয়ে চলেন তিনি। সবাইকে সাথে নিয়ে দাঁড়ান, বিপদের ঢাল হয়ে দাঁড়ান। টিমমেটের ব্যথায় কাঁদেন তিনি। আর তার ব্যথায় কাঁদেন সবাই। তাকে ভালোবেসে প্রেমিকরা ডাকে ‘ম্যাশ’, ‘বস’ কেউবা ডাকে ‘গুরু’। এতো ভালোবাসা কোথায় পেলেন তিনি? কি এমন তার জাদু? কেন মাশরাফি বলতে পাগল বাংলাদেশের সব ক্রিকেট ভক্তরা? আর তিনিই বা কেন পাগল তার ভক্তদের? পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বেশ অনেক ক্রিকেটারকেই পেয়েছে তাদের অধিনায়ক হিসেবে। কিন্তু অধিনায়কের জন্য তার টিমমেট থেকে শুরু করে সারা দেশব্যাপী এমন ভালোবাসা বোধহয় আর কেউ পা

7 things to consider before choosing a rent-house

It's a headache, tedious and hectic job to search for a rent-house for you or your family. If you are lucky enough to find an apartment, other things may bother you. Sometimes your budget may exceed. At times location and environment don't suit your demand. There are also some issues in the house that you can't ignore. However, it would be best if you found a rent-house within a short time as you are busy or tenant in another rent-house. It will be a much more troublesome job if you are looking for a rent-house for the first time. Worry not, remember these essential tips below, and you are on your way to choose a beautiful and perfect rent-house that fits your taste.   Choose your preferred area according to your budget First thing first, you should always choose your preferred area according to your budget. Not to mention, your workplace is another crucial factor in selecting the residing area. Let's assume, your office is in Uttara, you are married, and your s

মার্কেটিং কপি- আকিজ গ্রুপ

   কাঁচা কিংবা পাকা খাই , ফ্রুটিকাতেই মজা পাই   আফি ঝাল চানাচুর , ঝালে ঝালে সকাল দুপুর । পারফেক্ট খিচুড়ি আর মাংশ ভুনায় আফি ’ র আচার স্বাদ যোগায় । ফার্ম ফ্রেশ দুধ , শুধুই দুধ আর কিছু নয় । Vanita, the beauty of your kitchen & bathroom. Kathena, the mirror of your floors.